মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: এক দেশ, এক নির্বাচন (One Nation One Election)। দীর্ঘদিন ধরেই এর পক্ষে সওয়াল করে আসছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (PM Modi)। সোমবারই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও বলেছিলেন, মোদি সরকারের তৃতীয় মেয়াদেই এক দেশ, এক নির্বাচন কার্যকর করা হবে। এ সংক্রান্ত রিপোর্টও পেশ করেছে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বাধীন কমিটি।
কেন এক দেশ, এক নির্বাচন (One Nation One Election)
বুধবার কোবিন্দ কমিটির সেই প্রস্তাব অনুমোদনও করেছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। জানা গিয়েছে, সংসদের শীতকালীন অধিবেশনেই পেশ করা হবে এ সংক্রান্ত বিলটি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের এহেন প্রস্তাবের বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করেছে বিজেপি বিরোধী বিভিন্ন দল। তার পরেও বিলটি সংসদে পেশ করতে ও পাশ করাতে মরিয়া মোদি সরকার। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রের যুক্তি স্পষ্ট। এক দেশ, এক নির্বাচন কার্যকর হলে বারবার ভোট করতে যে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ হয়, তা বন্ধ হবে। নির্বাচনের নির্ঘণ্ট ঘোষণা হওয়ার পরেই লাগু হয়ে যায় আদর্শ আচরণবিধি। এই কারণে থমকে যায় উন্নয়নমূলক কাজকর্ম। উন্নয়নের গতির চাকা থমকে যাওয়ায় সমস্যায় পড়েন সাধারণ মানুষ। এহ বাহ্য। ঘন ঘন নির্বাচন হলে ঝামেলা পোহাতে হয় ভোট কর্মীদের। তাদের প্রশিক্ষণের পেছনে ব্যয় হয় সময়, অর্থ। কাজকর্ম ফেলে তাঁদের যেতে হয় ভোট করাতে। এক দেশ, এক নির্বাচন হলে, এই তিন সমস্যাই মিটবে। তার পরেও অযথা বিরোধীরা হইচই করছেন বলে অভিযোগ।
বিশ্বের অনেক দেশেই রয়েছে এই ব্যবস্থা
অথচ, বিশ্বের অনেক দেশেই চালু হয়েছে এক দেশ, এক নির্বাচন (One Nation One Election) ব্যবস্থা। এই তালিকায় যেমন রয়েছে সুইডেন, বেলজিয়ামের মতো দেশ, তেমন রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকাও। এই দেশগুলিতে জাতীয় ও রাজ্য নির্বাচন হয় একই সঙ্গে। বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশেও চালু রয়েছে এই ব্যবস্থা। এ তো গেল বিদেশের কথা। ভারতেও বেশ কয়েকবার একই সঙ্গে নির্বাচন হয়েছে লোকসভা ও বিধানসভার। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হয়। প্রথমবার নির্বাচন হয় ১৯৫২ সালে। তার পর থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত যত নির্বাচন হয়েছে, প্রতিবারই লোকসভার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন হয়েছে বিধানসভারও। দিব্যিই চলছিল এই ব্যবস্থা। গোল বাঁধে ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ভেঙে গিয়েছিল কয়েকটি বিধানসভা। শুরু হয় অকাল নির্বাচন। তার পর থেকে আর এক সঙ্গে ভোট হয়নি। লোকসভা এবং রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন হয়েছে আলাদা আলাদা সময়ে।
এই ব্যবস্থায়ই বদল আনতে চান মোদি
এই ব্যবস্থাতেই বদল আনতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (PM Modi)। আজ নয়, তিনি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, সেই সময় থেকেই। ২০১৪ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদি। সেই সময়ও তিনি এক দেশ, এক নির্বাচনের প্রস্তাব দেন। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বিজেপি যে ইস্তাহার প্রকাশ করেছিল, তাতেও এক দেশ, এক নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। তবে দ্বিতীয় মোদি জমানায় সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার। সেই দফায় জম্মু-কাশ্মীর থেকে রদ হয়েছিল ৩৭০ ধারা এবং ৩৫ এ ধারা। তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসেই এক দেশ, এক নির্বাচন কার্যকর করতে কোমর কষে মাঠে নেমে পড়েছে মোদি সরকার। সোমবারই যার প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের গলায়।
কোবিন্দ কমিটি
তবে এক দেশ, এক নির্বাচন (One Nation One Election) কার্যকর করতে মোদি সরকার যে বদ্ধপরিকর, তার আঁচ মিলেছিল গত সেপ্টেম্বরেই। তখনও লোকসভা নির্বাচনের ঢের দেরি। মোদি সরকার ক্ষমতায় ফিরবে কিনা, তাও নিশ্চিত ছিল না। তা সত্ত্বেও, কার্যত দেশের স্বার্থেই এক দেশ, এক নির্বাচন প্রস্তাব কার্যকর করতে কোবিন্দের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে মোদি সরকার। সেই কমিটি কথা বলে দেশের ৩৯টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে। আলোচনা করে অর্থনীতিবিদ এবং ভারতের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে। বিশ্বের যেসব দেশে এক সঙ্গেই সাধারণ নির্বাচন ও প্রাদেশিক আইনসভাগুলির নির্বাচন হয়, সেসব দেশে কীভাবে এই ব্যবস্থা পরিচালিত হয়, তাও খতিয়ে দেখে কোবিন্দ কমিটি। শেষমেশ দিন কয়েক আগে রিপোর্ট পেশ করে সেই কমিটিই। তার পরেই এ নিয়ে শুরু হয়েছে দেশজুড়ে চর্চা।
কীভাবে কার্যকর করা হবে
কোবিন্দ কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দু’ধাপে কার্যকর করা যেতে পারে এই ব্যবস্থা। প্রথমে একযোগে হবে লোকসভা ও বিধানসভাগুলির নির্বাচন (One Nation One Election)। এর ঠিক ১০০ দিনের মধ্যে করা হবে দেশের সব পুরসভা ও গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচন। অবশ্য, এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন। সংসদ ও রাজ্য বিধানসভাগুলির মেয়াদ, লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভা ভেঙে দেওয়া এবং রাষ্ট্রপতি শাসন জারি সংক্রান্ত বিষয়গুলি সংশোধন করতে হবে। সংশোধন করতে হবে সংবিধানের ৮৩ ও ১৭২ নম্বর ধারা। এই দুই ধারায় বলা হয়েছে সংসদ ও রাজ্য বিধানসভাগুলির মেয়াদ কতদিনের হবে।
কমিটি জানিয়েছে, শাসন ব্যবস্থাকে ব্যাহত না করে নির্বাচনগুলিকে একত্রিত করার জন্য টেকসই আইনি ব্যবস্থা প্রয়োজন। মেয়াদ ফুরনোর আগে কোনও সরকারের বিলুপ্তি ঘটাতে হলে সেই জায়গায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে। অথবা সুসঙ্গত নির্বাচন চক্রে সামিল করতে নির্বাচনের মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদের সরকার গঠন করা যেতে পারে।
বাড়বে ভোটার
কোবিন্দ কমিটির রিপোর্টে এক দেশ, এক নির্বাচনের (One Nation One Election) সুখ্যাতি গাওয়া হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছিল, একযোগে নির্বাচন হলে নির্বাচনী খরচ এক ধাক্কায় কমে যাবে অনেকটা। প্রশাসনিক বোঝাও হালকা হবে। বাড়বে ভোটারের সংখ্যাও। কমিটির বক্তব্য, বারবার নির্বাচন হলে অনেক সময়ই ভোট দেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন ভোটাররা। কর্মসূত্রে যাঁরা বাইরে থাকেন, তাঁদের সমস্যাটা আরও বেশি। কাজের ক্ষতি করে মোটা টাকা গচ্চা দিয়ে বারবার ভোট দিতে ‘গাঁয়ে’ ফেরা তাঁদের পক্ষেও বোঝা স্বরূপ। এক সঙ্গে নির্বাচন হলে, এক ঢিলে তাঁরা মারতে পারবেন দুই পাখি। এক খরচে এবং এক ছুটিতেই লোকসভা ও বিধানসভার ভোট দিয়ে তাঁরা ফিরতে পারবেন কর্মস্থলে।
২০২৯ সালেই এক দেশ, এক নির্বাচন
দেশে ফের লোকসভা নির্বাচন হবে ২০২৯ সালে। সে ক্ষেত্রে কী হবে সেই সব রাজ্যের, যেগুলিতে আগামী বছরই নির্বাচন রয়েছে? এই তালিকায় রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ এবং তামিলনাড়ু। কোবিন্দ কমিটির রিপোর্টে সেই প্রসঙ্গেরও অবতারণা করা হয়েছে। এবং কীভাবে এর সমাধান করা হবে, তাও বাতলে দেওয়া হয়েছে। যেসব রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হবে ২০২৫ সালে, সেই সব রাজ্যের বিধানসভার মেয়াদ হবে চার বছরের। আবার কর্নাটকের মতো রাজ্য যেখানে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা ২০২৮ সালে, সেখানে বিধানসভার মেয়াদ হবে মাত্রই কয়েক মাসের।
আরও পড়ুন: মেডিক্যাল কলেজে কায়েম ‘থ্রেট কালচার’, জানুন এই সংস্কৃতি সম্পর্কে
যদি কখনও কোনও কারণে মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই সংসদ ভেঙে দেওয়ার প্রয়োজন হয়, তখন নতুন করে নির্বাচন আয়োজনের পরামর্শও দিয়েছে কোবিন্দ কমিটি। সেক্ষেত্রে পরবর্তী মেয়াদকে এমনভাবে সীমাবদ্ধ করতে হবে যাতে তাকে মিলিয়ে (PM Modi) দেওয়া যায় পরবর্তী এক দেশ, এক নির্বাচনের (One Nation One Election) সঙ্গে।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Whatsapp, Facebook, Twitter, Telegram এবং Google News পেজ।
+ There are no comments
Add yours