মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: "চিত্ত যেথা ভয় শূন্য, উচ্চ যেথা শির" এই সংকল্পই ছিল তাঁর মন্ত্র। তিনি স্বাধীনতাকে নিজের দেশের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চানিনি। স্বাধীনতা মানে হল তাঁর কাছে স্বপ্ন, সমান অধিকারের দাবি। ঘরে-বাইরে বিশ্ব মাঝে স্বাধীনতার দাবি জানিয়েছিলেন পাঞ্জাবের মাখন সিং। কেনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদানকারী এক বিরল ভারতীয় নেতা হলেন মাখন সিং। মাখন সিং, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের উদাসীনতা স্বীকার করে, তার জন্মভূমি এবং তার দত্তক বাড়ি উভয় ক্ষেত্রেই অন্যায়ের বিরোধিতা করার জন্য আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ভারত এবং কেনিয়াতে আরও ন্যায়সঙ্গত রাজনীতির ভিত্তি স্থাপনের জন্য সিংয়ের সংকল্প অনুপ্রেরণাদায়ক।
মাখন সিং-এর জন্ম
মাখন সিং ১৯১৩ সালের ডিসেম্বরে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে বেশিরভাগ সময় তিনি অবিভক্ত পাঞ্জাবে কাটিয়েছিলেন। তার বয়স যখন ছয়, তার বাবা, কেনিয়ায় চলে যান। সেই সময় অনেক পাঞ্জাবি রেলওয়েতে কাজ করার জন্য কেনিয়া পাড়ি দিয়েছিলেন। মাখন সিংও ১৪ বছর বয়সে তাঁর মা এবং বোনের সঙ্গে কেনিয়াতে বাবার কাছে চলে যান। তার আগেই দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাক তাঁর মনে দাগ কেটেছিল। মাখনের বাবা রেলওয়ে ছেড়ে দিয়ে একটি ছাপাখানায় যোগ দেন। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই বাবাকে প্রেসের কাজে সাহায্য করতে থাকেন মাখন। এই সময়েই তিনি ট্রেড ইউনিয়নের প্রতি আগ্রহী হন। এই সময়ে মুদ্রণ শিল্পে শ্রমিকদের নানা দাবি নিয়ে শ্রমিক ধর্মঘট সংগঠিত করেছিলেন মাখন।
শ্রমিকদের জন্য দাবি
শ্রমিকদের কাছে একটি আবেগপ্রবণ ভাষণে মাখন সিং 'উহুরু সাসা' দাবি করেছিলেন, যার কিসোয়াহিলি অর্থ ছিল 'এখনই স্বাধীনতা'। এটি ছিল ব্রিটেনের কাছ থেকে কেনিয়ার সম্পূর্ণ স্বাধীনতার প্রথম আহ্বান। বাবার ছাপাখানায় কাজ করতে করতে শ্রমিকদের শোষণ এবং ঔপনিবেশিক অবিচার সম্পর্কে জানতে পারেন মাখন। এখানেই তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মিত্র, গদর [গদর নামেও লেখা] পার্টির সদস্যদের সাথে দেখা করেছিলেন। এই আন্দেলনে শ্রমিকদের স্বার্থে মাখন নিজের বাবার বিরুদ্ধেও দাঁড়ান। তিনি বলেছিলেন যে তাঁর ক্রিয়াকলাপ "পরিস্থিতিতে ন্যায়সঙ্গত"।
বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই
এক সময় পূর্ব আফ্রিকার উপনিবেশগুলিতে বসতি স্থাপনের জন্য ব্রিটিশরা ভারতীয়দের উৎসাহিত করত। এই ভারতীয়দের অধিকাংশই ছিল ব্যবসায়ী, কারিগর বা নিম্ন পেশাজীবী, যারা ঔপনিবেশিক শ্রেণিবিন্যাসে কালো ও সাদাদের মধ্যবর্তী অবস্থান দখল করত। তাঁরা আফ্রিকান এবং ইংরেজ উভয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাঁদের নিজস্ব বৃহৎ সম্প্রদায়ে বাস করত। তারা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর ব্রিটিশ শাসনের অপরিহার্য হাতিয়ার ছিল এবং ব্রিটিশদের তুলনায় আফ্রিকানদের সাথে তাদের বেশি যোগাযোগ ছিল। এইভাবে, তাঁরা সেই দেশে আফ্রিকানদের থেকে বেশি সুযোগ সুবিধা পেলেও, কৃষ্ণাঙ্গরা তাঁদের প্রতি বিরক্ত হত। মাখনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল রঙের বাধা ভেঙে ভারতীয় ও আফ্রিকান জনগণকে এক করে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের চ্যালেঞ্জ করা। ১৯৩৪ সালে লেবার ট্রেড ইউনিয়ন অফ কেনিয়ার সম্পাদক (LTUK) নির্বাচিত হন। এই সংগঠন সমস্ত বর্ণের সদস্যদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। এদের উদ্দেশ্য ছিল নিপীড়িত সম্প্রদায়গুলিকে একত্রিত করা।
ভারতের সঙ্গে যোগ
কেনিয়ায় আন্দোলন সংগঠিত করার সঙ্গে সঙ্গে নিজের জন্মভূমি ভারতে ঘটে চলা নানা প্রতিবাদ সম্পর্কে অবগত ছিলেন মাখন। ১৯৩৯ সালে ভারতে আসেন তিনি। বম্বে এবং আমেদাবাদে ট্রেড ইউনিয়নিজমের কার্যকারিতা এবং শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে আসেন মাখন। তিনি তৎকালীন বোম্বেতে শ্রমিক ধর্মঘটকারীদের জনসভায় ভাষণ দেন। আফ্রিকান প্রতিনিধি হিসাবে রামগড়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনেও যোগ দিয়েছিলেন মাখন। তাঁর ঔপনিবেশিক বিরোধী সংবেদনশীলতা সমস্যায় ফেলতে পারে এই ভয়ে, ব্রিটিশরা তাঁকে গ্রেফতার করে। দুই বছর ধরে এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় মাখনকে। আড়াই বছরের জন্য গুজরানওয়ালায় তাঁর নিজের গ্রামে তাঁকে নজরবন্দি করে রাখে ব্রিটিশরা। অবশেষে ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাসে ব্রিটিশরা তাঁকে মুক্তি দেয়। এরপর তিনি একটি বিপ্লবী সাপ্তাহিক জং-ই-আজাদির সাব-এডিটর হিসেবে কাজ পান। এরপরে ১৯৪৭ সালে ফের তিনি কেনিয়ায় ফিরে যান।
আরও পড়ুুন: তৃতীয় দফায় কী প্রচার করবেন, কৌশল বাতলে এনডিএ প্রার্থীদের চিঠি মোদির
কেনিয়ার স্বাধীনতা
কেনিয়ায় ফিরে মাখন ফের ঔপনিবেশিক বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। তিনি কেনিয়া যুব সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। পূর্ব আফ্রিকান ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কাজে সক্রিয় হন মাখন। পূর্ব আফ্রিকান ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, আফ্রিকান বিপ্লবী ফ্রেড কুবাই এর সভাপতি ছিলেন তিনি। মাখন ভারতীয়দের আফ্রিকানদের সাথে একত্রে কাজ করার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন। পাঞ্জাবি, গুজরাটিদের জন্য কেনিয়ায় স্কুল স্থাপন করেছিলেন। ১৯৫০ সালে ব্রিটিশ সরকার সিংকে শেষবারের মতো আটক করার পরেই মউ মউ বিদ্রোহ শুরু হয়। ১৯৬১ সালে ব্রিটিশরা ঔপনিবেশিক বিদ্রোহের প্রতিক্রিয়ায় জারি করা জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার পর তিনি মুক্তি পান। এরপর মাখন স্বাধীন কেনিয়ার প্রথম প্রধান জোমো কেনিয়াত্তার জন্য প্রচার শুরু করেন। মাখন বিশ্বাস করতেন যে স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের সাধনা আপনার জন্মের দেশ দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। অবশেষে তিনি রাজনৈতিক লাইমলাইট থেকে দূরে সরে যান এবং ১৯৭৩ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে নাইরোবিতে তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু তাঁর জীবন ও আন্দোলন সারা পৃথিবীর মানচিত্রে দাগ কেটে যায়।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Whatsapp, Facebook, Twitter, Telegram এবং Google News পেজ।
+ There are no comments
Add yours