তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় পাল: বাড়িতেই পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে গিয়েছে বছর পঞ্চান্নের জয়ন্তী ভট্টাচার্যের। রানাঘাটের বাসিন্দা জয়ন্তী দেবীর হাতের অস্ত্রোপচার জরুরি। কিন্তু কৃষ্ণনগর থেকে কল্যাণী একাধিক সরকারি হাসপাতালে গিয়েও পরিষেবা পাওয়া যায়নি। হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছে, অস্ত্রোপচার করার জন্য বিশেষজ্ঞ অস্থি-শল্য চিকিৎসক নেই। তাই তাকে কলকাতার হাসপাতালে রেফার করা হয়। পরিবারের তরফে জানানো হয়েছে, হাজার দশেক টাকা গাড়ি ভাড়া খরচ করে কলকাতায় জয়ন্তী দেবীকে আনা হয়। তারপরে একাধিক সরকারি হাসপাতালের লাইনে অপেক্ষা করে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের দিন পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু কল্যাণীতেই রয়েছে রাজ্য সরকারের জেএনএম মেডিক্যাল কলেজ। কিন্তু তারপরও সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব (Inavailability of Doctors) হাসপাতালের পরিকাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
আরও পড়ুন: মানিকের RK-DD ধাঁধা ঘাম ঝরাচ্ছে গোয়েন্দাদের, রহস্যভেদে ময়দানে 'ফেলুদা' শুভেন্দু
পশ্চিম মেদিনীপুরের বাসিন্দা অসীম রায়ের মেরুদণ্ডের সমস্যা। স্নায়ুর অস্ত্রোপচার করতে হবে। চিকিৎসক জানান, অস্থি ও স্নায়ু শল্য চিকিৎসকের সমন্বয়ে অস্ত্রোপচার সম্ভব। কিন্তু জেলার সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে এই সমন্বয় সম্ভব নয়। কারণ, অস্থি ও স্নায়ু শল্য চিকিৎসক নেই। এমনকি পাশের জেলার মেডিক্যাল কলেজেও সেই পরিকাঠামো নেই। তাই তাকে পাঠানো হয় কলকাতায়। কয়েক মাস অপেক্ষা করে অবশেষে বাঙ্গুর ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেসে অস্ত্রোপচারের সুযোগ পেয়েছেন অসীম রায়।
রাজ্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা (Health Department) উন্নত করতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জেলায় জেলায় মেডিক্যাল কলেজ তৈরি করছেন। একাধিক সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল ও তৈরি হয়েছে। কিন্তু তারপরেও জেলার মানুষদের হয়রানির শেষ নেই। পশ্চিম মেদিনীপুরের অসীম রায় কিংবা রানা ঘাটের জয়ন্তী ভট্টাচার্যের হয়রানি কোনও ব্যতিক্রম নয়। কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলোতে রোগী অপেক্ষার যে দীর্ঘ লাইন, তাতে জেলার মানুষের সংখ্যাই বেশি। দূর থেকে কলকাতায় রোগীকে নিয়ে এসে দিনের পর দিন চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। অনেক সময় চিকিৎসার নূন্যতম সুযোগ ও পান না অনেকেই।
স্বাস্থ্য দফতরের একাংশের অবশ্য দাবি, রোগী হয়রানির জন্য অনেকাংশেই দায়ী স্বাস্থ্য ভবনের পরিকল্পনার অভাব। হেলথ সার্ভিসের চাকরিরত একাধিক চিকিৎসক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক (এমডি, এমএস) পড়া শুরু করেন। ২০১৮ সাল থেকে যে সব চিকিৎসক এই স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শুরু করেছিলেন ২০২১ সালে, তাদের কোর্স শেষ হয়ে যায়। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতর তাদের প্রয়োজন মতো নিয়োগ করতে পারেননি। স্বাস্থ্য ভবনের এক কর্তা বলেন, "রাজ্যের প্রায় সাড়ে ছ'শো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে ঠিকমতো নিয়োগ করা হয়নি। জেলার যেসব হাসপাতালে এমডি, এমএস চিকিৎসক জরুরি, সেখানে নিয়োগ করা হচ্ছে না। ওই চিকিৎসকদের অধিকাংশ কলকাতার যেসব মেডিক্যাল কলেজে স্নাতকোত্তর পড়তে এসেছিলেন, সেখানেই কাজ করছেন। অথচ তাদের বেতন দেওয়া হচ্ছে অন্য হাসপাতাল কর্মরত এটা দেখিয়ে। কোথাও অতিরিক্ত চিকিৎসক, আবার কোথাও চিকিৎসক নেই। প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা না থাকলে ভালো পরিষেবা সম্ভব নয়।"
জেলার একাধিক সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে স্নায়ু, স্নায়ু-শল্য, পেডিয়াট্রিক-সার্জারি, কার্ডিওভাসকুলার সার্জারির মতো বিভাগগুলো বন্ধ হয়ে থাকে। কারণ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব। এদিকে কলকাতার হাসপাতালগুলোতে স্নাতকোত্তর পাশ করে সিনিয়র রেসিডেন্স হয়ে কাজ করছেন একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। দফতরের ঠিকমতো সমন্বয়ের অভাবের জেরেই রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবা তলানিতে গিয়ে ঠেকছে। আর ভুক্তভোগী হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
জেলা থেকে কলকাতায় আনার পথে রোগী মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। কিন্তু তারপরেও হুশ ফেরেনা স্বাস্থ্য দফতরের। যদিও স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, সম্প্রতি দফতরের থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, আগামি ১৮ অক্টোবরের মধ্যে যথাযথভাবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নিয়োগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যে হাসপাতালে কর্মরত দেখিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বেতন হচ্ছে, সেখানেই তাদের নিয়োগ পত্র দিতে হবে। দ্রুত এই কাজ শেষ করতেই সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে বলে জানাচ্ছেন স্বাস্থ্য কর্তারা। কিন্তু তারপরেও বিজ্ঞপ্তি কতখানি কার্যকর হবে সে নিয়ে অবশ্য সংশয়ে স্বাস্থ্য কর্তাদের একাংশ।
+ There are no comments
Add yours