তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় পাল: কৃষ্ণনগর থেকে ক্যানসারের (Cancer) চিকিৎসা করাতে কলকাতার এনআরএস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসেন স্বপন চৌধুরী। বছর পঞ্চাশের স্বপন বাবুর পেটে বাসা বেঁধেছে ক্যানসার। নিয়মিত রেডিওথেরাপি করানোর পাশাপাশি প্রয়োজন ওষুধের। কিন্তু হাসপাতালের ন্যায্যমূল্যের দোকানে অধিকাংশ সময়েই ক্যানসারের ওষুধ পাওয়া যায় না। তাই রেডিওথেরাপি হয়ে গেলে হাসপাতাল চত্বরের গাছ তলায় স্বপন বাবুকে বসিয়ে রেখে স্ত্রী যান ওষুধ কিনতে। স্বপন বাবু বলেন, "এক সঙ্গে সব ওষুধ কেনার মতো সামর্থ্য নেই। সবচেয়ে কম দামের ওষুধ কিনতেই অন্তত দু'হাজার টাকা খরচ হয়। নামেই ফ্রি। হাসপাতালে কোনও ওষুধ পাওয়া যায় না।" স্বপন বাবুর স্ত্রী বলেন, "তিন বার এলাম। এক বার ও একটাও ওষুধ পেলাম না। এত বড় দোকান হাসপাতালের ভিতরে কেন করেছে, জানি না। এত খরচ সামলাবো কীভাবে! ক্যানসারের ট্রিটমেন্ট তো একদিনের ব্যাপার না। "
এসএসকেএম হাসপাতালে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করাতে সোদপুর থেকে যান বছর পয়ষট্টির অনিকেত রায়। চিকিৎসক ফ্রি-তে পরিষেবা দিলেও নগদ টাকায় ওষুধ কিনতে হয়। কারণ, অধিকাংশ সময়েই ন্যায্য মূল্যের দোকানে ওষুধ থাকে না। অনিকেত বাবু বলেন, "ওষুধ অধিকাংশ সময়েই বাইরের দোকান থেকে কিনে নিই। ন্যায্যমূল্যের দোকানে ওষুধ থাকে না। বাইরের ওষুধ দোকানে তো স্বাস্থ্য সাথী কার্ড চলবে না। তাই নগদ টাকাতেই ওষুধ কিনতে হয়।" ডায়বেটিসের মতো ক্রনিক রোগে ধারাবাহিকভাবে নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। অনিকেত বাবু বলেন, "বয়স্ক মানুষদের এই সব ক্রনিক রোগের ওষুধ যদি কখনোই সরকারি দোকানে পাওয়া না যায়, তাহলে আর সবকিছু বিনামূল্যে বলে লাভ কি! "
শুধুমাত্র ধারাবাহিক রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে নয়, জরুরি চিকিৎসার ওষুধ ও অধিকাংশ সময় পাওয়া যায় না। পথ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজে দিন কয়েক আগে এক মহিলা ভর্তি হয়েছিলেন। তার পরিবারের অভিযোগ, হাসপাতাল থেকে যে পাঁচটি ওষুধ প্রয়োজন বলে প্রেসক্রিপশনে লেখা হয়েছিল, তার চারটিই ন্যায্যমূল্যের দোকানে পাওয়া যায়নি।
এই ঘটনাগুলো ব্যতিক্রম নয়। রাজ্যের অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালের ন্যায্যমূল্যের ছবিটা এরকমই।
ক্যানসারের জীবনদায়ী ওষুধ, ডায়বেটিসের মতো ক্রনিক রোগের ওষুধ কিংবা করোনার মতো মহামারি ঠেকানোর ইঞ্জেকশন, সরকারি হাসপাতালের ন্যায্য মূল্যের দোকানে হয়রানিই যেন নিত্য সঙ্গী।
এসএসকেএম-র মতো রাজ্যের প্রথম সারির সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল হোক কিংবা যে কোনও জেলা হাসপাতাল, সরকারি হাসপাতাল চত্বরে থাকা, ন্যায্য মূল্যের ওষুধ দোকানে অধিকাংশ সময়েই ওষুধ পাওয়া যায় না। পরিজনকে হাসপাতালে রেখেই এক দোকান থেকে আরেক দোকানে ছোটেন আত্মীয়রা। নগদ টাকায় হাসপাতালের বাইরের দোকান থেকে ওষুধ কিনতে হয়। স্বাস্থ্য সাথী কার্ড থাকলেও ওষুধের দোকানে তো সেই কার্ডের পরিষেবা পাওয়া যায় না।
আরও পড়ুন: নবান্নে CMO তে অভিযোগের পাহাড়! কাজই করছে না বহু দফতর?
সরকারি হাসপাতালে নিখরচায় সমস্ত পরিষেবাই পাওয়া যাবে। অন্তত এমনটাই বারবার বলে রাজ্য সরকার। শহর থেকে জেলা, সব রাস্তায় পশ্চিমবঙ্গে নিখরচায় চিকিৎসার বিজ্ঞাপনে মোড়া। কিন্তু বাস্তবের ছবি অনেকটাই আলাদা। চিকিৎসার প্রথম ও প্রধান শর্ত ওষুধ, পেতেই হিমশিম অবস্থা সাধারণ মানুষের।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) ক্ষমতায় আসার পরেই রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ন্যায্যমূল্যের ওষুধ দোকান তৈরি হয়েছিল। সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছিল, এই দোকানগুলো থেকে বিনামূল্যে ওষুধ পাবেন সাধারণ মানুষ। নিখরচায় চিকিৎসার এই ছিল প্রথম শর্ত। কিন্তু বাস্তবে এই দোকানগুলো থেকে হয়রানি ছাড়া আর কিছুই জুটছে না।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ওষুধ নিয়ে দুর্নীতি দীর্ঘদিনের। সরকারি হাসপাতালে ওষুধ ঠিকমতো স্টোর থেকে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছয়না। অসাধু চক্রের বাসা জাকিয়ে বসেছে প্রত্যেক হাসপাতালে।
স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার কথায়, "এই সব অসাধু চক্র শেষ না করলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমবে না। তবে, এই সব চক্র শেষ করা কঠিন। কারণ, এই সব অসাধু চক্রের মাথায় রাজনৈতিক নেতাদের প্রচ্ছন্ন মদত রয়েছে। সরকারের কাছকাছি থাকা নেতাদের অঙ্গুলি হেলনেই সব চলছে। "
প্রসঙ্গত গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে করোনার জীবনদায়ী ওষুধ টসিলিজুমাব ইঞ্জেকশন চুরির অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিধায়ক চিকিৎসক নির্মল মাজির বিরুদ্ধে। ওই ইঞ্জেকশনের বাজারে মূল্য চল্লিশ হাজার টাকা। অভিযোগ উঠেছিল, অবৈধভাবে ওই ইঞ্জেকশন হাসপাতাল থেকে বাইরে বিক্রি হচ্ছে। যদিও পরে রাজ্য সরকারের তদন্ত কমিটি নির্মল বাবুকে ক্লিনচিট দিয়ে দেয়।
স্বাস্থ্য কর্তাদের একাংশের মতে, প্রত্যেক হাসপাতালের ন্যায্যমূল্যের ওষুধ দোকানে নজরদারি জরুরি। তবে সবচেয়ে বেশি জরুরি সদিচ্ছার। সাধারণ মানুষকে পরিষেবা দেওয়ার সদিচ্ছা থাকলে তবেই ওষুধ নিয়ে অসাধু চক্র ভাঙা যাবে। তারপরে পরিষেবা দেওয়া সম্ভব। না হলে, এই ভোগান্তির শেষ কোথায়, সেই উত্তর পাওয়া কঠিন।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook এবং Twitter পেজ।
+ There are no comments
Add yours