হরিহর ঘোষাল
মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (RG Kar Hospital) ডাক্তারি ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় এখন সারা বাংলা-তথা দেশ তোলপাড়। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ পথে নেমে এর সুবিচারের দাবি জানাচ্ছেন। কিন্তু, এই হাসপাতালের সৃষ্টি এবং স্রষ্টার ইতিহাস জানেন কি? সম্পূর্ণ কাহিনি শুনলে অবাক হবেন। জানা যায়, এই হাসপাতাল তৈরি করেছিলেন বিলেত ফেরত ডাক্তার রাধাগোবিন্দ কর।
কে এই রাধাগোবিন্দ কর? (RG Kar Hospital)
বেলগাছিয়া (Kolkata) থেকে দমদম বাড়ি বাড়ি সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়াতেন এক ডাক্তার। মাথায় একটা টুপি আর সাইকেলে ঝোলানো ক্যামবিসের ব্যাগ। রোগী দেখাই শেষ নয়, নানা ভাবে সহযোগিতা এমনকী ওষুধ কেনার পয়সাও দিচ্ছেন তিনি। সেই ডাক্তারবাবুর নাম রাধাগোবিন্দ কর। আরজি কর হাসপাতালের (RG Kar Hospital) স্রষ্টা তিনি। সারা বাংলার মানুষের চিকিৎসার সুবিধার্থে একজন ডাক্তার সারাটা জীবন লড়াই করেছেন। হাওড়া জেলার রামরাজাতলা স্টেশন থেকে সামান্য দূরত্বে বেতড়ের বিখ্যাত কর বাড়ি তাঁর জন্মভিটে। ১৮৫০ সালের ২৩ অগাস্ট তাঁর জন্ম। জানা যায়, বাবা দুর্গাদাস কর ছিলেন অবিভক্ত বাংলায় মেডিক্যাল অফিসার। তিনি ঢাকা মিডফোর্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর রাধাগোবিন্দ কর কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করার পর চিকিৎসা বিজ্ঞানের পাঠ গ্রহণের জন্য ১৮৮০ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। ১৮৮৩ সালে ডাক্তারি পড়তে কলকাতা ছেড়ে স্কটল্যান্ডে পাড়ি দেন তিনি। ১৮৮৭ সালে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসা বিদ্যার শ্রেষ্ঠ অলংকারে ভূষিত হলেন তিনি। এমআরসিপি হয়ে বিদেশে ডাক্তারি করার সুযোগ থাকলেও তিনি ফিরে এলেন এই বাংলায়। একজন বিলেত ফেরত ডাক্তার হয়ে বাংলার অসহায় গরিব মানুষদের পাশে দাঁড়ালেন তিনি।
হাসপাতাল তৈরির জন্যে ভিক্ষা!
এদেশের মানুষের জন্য একটি হাসপাতাল তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন রাধাগোবিন্দ কর। হাসপাতালের অর্থ সংগ্রহ করতে সে সময় এই বিলেত ফেরত ডাক্তার ভিক্ষা পর্যন্ত করেছেন। তখনকার দিনে কলকাতার বড়লোকদের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করেছেন। বড়লোক বাড়িতে কোনও আনন্দ-অনুষ্ঠান হলে সেই বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন, হাত পেতে ভিক্ষা চাইতেন তিনি। চিকিৎসক হিসেবে অর্জিত অর্থের সমস্তটাই দান করে গিয়েছেন মেডিক্যাল স্কুল ও হাসপাতাল স্থাপনে।
আরজি কর হাসপাতাল তৈরির আদি কথা
১৮৯৮ সালে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে বেলগাছিয়ায় ১২ বিঘে জমি কিনে নেন রাধাগোবিন্দ কর। এরপর সেখানেই ৭০ হাজার টাকা খরচ করে গড়ে তোলেন হাসপাতাল (RG Kar Hospital)। ঠিকানা, ১ নম্বর বেলগাছিয়া রোড। শয্যাসংখ্যা ৩০। হাসপাতাল পরিদর্শন করতে এসে প্রিন্স অ্যালবার্ট ভিক্টর দান করেন ১৮ হাজার টাকা। এই বিপুল পরিমাণ টাকা সাহায্য করার জন্য হাসপাতালের নাম রাখা হয় 'অ্যালবার্ট ভিক্টর হাসপাতাল'। ১৯০৪ সালে এই হাসপাতালের সঙ্গে মিশে যায় কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জেনস অব বেঙ্গল। তারও ১০ বছর পর মেলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন। তখন নামকরণ হয় বেলগাছিয়া মেডিক্যাল কলেজ। ১৯১৬ সালের ৫ জুলাই সেই কলেজের দ্বিতল ভবনের উদ্বোধন করেন লর্ড কারমাইকেল। তাই তাঁর সম্মানে আবারও বদলে যায় এই চিকিৎসা কেন্দ্রের নাম। দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত নাম ছিল কারমাইকেল। ১৯১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৬৬ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রাধাগোবিন্দ কর। মৃত্যুর সময় তাঁর নিজস্ব সম্পত্তি বলতে কিছুই ছিল না। শুধু ছিল বেলগাছিয়ায় তাঁর একটি বাড়ি। সেই বাড়িটিও তিনি উইল করে দিয়ে যান এই মেডিক্যাল কলেজের নামে। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে রাধাগোবিন্দ করের নামেই কলেজের নাম রাখা হয় 'আরজি কর'। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১৯৫৮ সালের ১২ মে এটি গ্রহণ করে।
রাধাগোবিন্দ কর ও নিবেদিতা
১৮৯৯ সালে কলকাতা জুড়ে প্লেগ মহামারির আকার নেয়। সেই সময়ে উত্তর কলকাতার অলিতে গলিতে ঘুরে রোগীদের সেবা করছেন ভগিনী নিবেদিতা। আর বিলেত ফেরত ডাক্তার রাধাগোবিন্দ কর সাইকেলে করে এলাকা চষে বেড়ান। বেশিরভাগ রোগীই গরিব। পথ্য কেনারই পয়সা নেই, তার ওপর আবার ডাক্তাবের ফিস। রোগী দেখার সঙ্গে সঙ্গে দরকার হলে রোগীদের পথ্য কেনার টাকাও দিচ্ছেন বিলেত ফেরত ডাক্তারবাবু। এর কিছুদিন পরই নিবেদিতার সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। প্লেগ সংক্রমণ রুখতে এবং মৃত্যুর হার কমাতে দু'জনে মিলে একসঙ্গে কাজ করেছেন তাঁরা। ডাক্তারি পরিষেবা দেওয়ার পাশাপাশি বাংলাতে চিকিৎসা শাস্ত্রের ওপর একাধিক বইও লিখেছেন। যা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
এখন আরজি কর হাসপাতাল
বর্তমানে ১৫ একর জুড়ে বিস্তৃত ১২১০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল (RG Kar Hospital) কমপ্লেক্সে ১০টি ভবন এবং সাতটি হস্টেল রয়েছে। ২০১৫ সালে শতবর্ষ উদযাপনের সূচনা উপলক্ষে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীরা বলেন, এই মেডিক্যাল কলেজকে এক সময় অনেকে অবজ্ঞা করত। কারণ, তখন বেলগাছিয়াকে কলকাতা শহরের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হত না। তাই, এই মেডিক্যাল কলেজকে খালের কলেজ বলা হত। জানা গিয়েছে, এই হাসপাতালে এমবিবিএস, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করা হয়। বিএসসি নার্সিং, প্যারামেডিক্যাল শাখায় আরও কয়েকটি কোর্সের জন্য আসন রয়েছে। বিলেত থেকে ফিরে এদেশের মানুষের জন্য যে হাসপাতাল তৈরির চারাগাছ তিনি লাগিয়েছিলেন, আজ তা বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Whatsapp, Facebook, Twitter, Telegram এবং Google News পেজ।
+ There are no comments
Add yours