জিন্নার হিন্দু মন্ত্রীর পাঁচালি -পর্ব ৫
চতুর্থ পর্বের পর...
২১। ঢাকার দাঙ্গার পিছনে প্রধান কারণ ছিল ৫টি
(i) কালশিরা এবং নাচোলের ঘটনাসমূহের উপর ২টি মুলতুবি প্রস্তাব গণপরিষদে প্রত্যাখ্যাত হলে সংসদে হিন্দু প্রতিনিধিদের ওয়াক আউটের জন্য এবং হিন্দুদের শিক্ষাপ্রদানের উদ্দেশ্যে
(ii) সংসদীয় দলে সোহরাওয়ার্দী গ্রুপ এবং নাজিমুদ্দিন গ্রুপের মধ্যে দিন দিন বেড়ে চলা মতবিরোধ ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব
(iii) পূর্ব বাংলার সরকার এবং মুসলিম লিগ, হিন্দু-মুসলিম উভয় পক্ষের নেতারা পূর্ব-পশ্চিম দুই বাংলার মিলনের স্বপক্ষে একটি আন্দোলন শুরু করতে পারে এমন ভয়ে ভীত ছিল। তারা এই মিলন আটকাতে চাইছিল। তাদের পরিকল্পনা ছিল যে পূর্ব বাংলায় যেকোনও বড় আকারের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রভাব পশ্চিমবঙ্গেও পড়বে এবং সেখানে মুসলিমদের হত্যার ঘটনা ঘটতে পারে। উভয় বঙ্গে এরূপ দাঙ্গা দুই বাংলার মিলনকে রোধ করতে পারবে।
(iv) পূর্ব বাংলার বাঙালী এবং অবাঙালী মুসলিমদের মধ্যে বৈরিতা ক্রমশ বাড়ছিল। এটা রোধের একমাত্র উপায় ছিল পূর্ববঙ্গের মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়ানো। ভাষার ব্যাপারটিও এর সঙ্গে জড়িত ছিল।
(v) অবমূল্যায়নে অসম্মতি এবং ইন্দো-পাকিস্তান ব্যবসার ক্ষেত্রে অচলাবস্থার ফলাফল পূর্ব বাংলায় অনুভূত হচ্ছিল, প্রথমে শহরাঞ্চলে পরবর্তীতে গ্রামাঞ্চলেও। মুসলিম লীগের সদস্য এবং কর্মকর্তাগণ এই আসন্ন অর্থনৈতিক ধ্বস থেকে জনগণের মনোযোগ সরিয়ে দিতে হিন্দুদের বিরুদ্ধে জেহাদের সূচনা করতে চেয়েছিলেন।
হতভম্বকারী বর্ণনা-প্রায় ১০,০০০ মৃত্যু
২২। ঢাকায় আমার ৯ দিনের অবস্থানকালে আমি শহর ও শহরতলীর বেশিরভাগ দাঙ্গা আক্রান্ত অঞ্চলে গিয়েছি। তেজগাঁও এর অন্তর্ভুক্ত মিরপুরেও আমার যাওয়া হয়েছে। আমি সবচেয়ে মর্মাহত হয়েছি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে ট্রেনে শত শত নিরপরাধ হিন্দু হত্যার খবরে। ঢাকার দাঙ্গার দ্বিতীয় দিনে আমি পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তাকে অনুরোধ করি দাঙ্গা যেন জেলা শহর ও গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ যেন তিনি অবিলম্বে জেলা কর্তৃপক্ষ গুলোর নিকট পৌঁছে দেন। ২০ ফেব্রুয়ারী, ১৯৫০ তারিখে আমি বরিশাল শহরে পৌঁছে সেখানকার ঘটনা শুনে বিস্মিত হয়ে যাই। জেলা শহরে বেশকিছু হিন্দু ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়, প্রচুর হিন্দু নিহত হয়। আমি জেলাটির প্রায় সব দাঙ্গা আক্রান্ত অঞ্চল পরিদর্শন করেছি। জেলা শহরের ৬ মাইলের মধ্যে অবস্থিত এবং গাড়ি চলাচলের রাস্তা দিয়ে সংযুক্ত কাশিপুর, মাধবপাশা, লাকুটিয়ার মত জায়গাগুলোয় ধ্বংসযজ্ঞের পরিমাণ দেখে আমি বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। মাধবপাশা জমিদার বাড়িতে প্রায় ২০০ মানুষ নিহত হন, আহত হন আরো অন্তত ৪০ জন। মুলাদী নামক স্থানে যেন নরক নেমে আসে। স্থানীয় মুসলিমদের ও কিছু কর্মকর্তার ভাষ্য অনুসারে শুধু মুলাদী বন্দরেই ৩০০ এর বেশি লোক নিহত হয়। আমি মুলাদী গ্রামও পরিদর্শন করি এবং সেখানে মৃতদেহের কঙ্কাল পড়ে থাকতে দেখি। কুকুর এবং শকুন নদীর ধারে মৃতদেহ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। আমাকে অবগত করা হয় যে সকল পূর্ণবয়স্ক পুরুষকে হত্যার পর সমস্ত যুবতীদের দুর্বৃত্ত দলের হোতাদের মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়। রাজাপুরের অন্তর্গত কৈবর্তখালী নামক স্থানে ৬৩ জন নিহত হয়। থানা থেকে ঠিল ছোঁড়া দূরত্বে অবস্থিত হিন্দু বাড়িগুলোতেও লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়, সেগুলোতে বসবাসকারীদের হত্যা করা হয়। বাবুগঞ্জ বাজারের সকল হিন্দু দোকানে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে, বহু হিন্দু নিহত হয়। বিস্তারিত বর্ণনা পাবার পর কম করে ধরলেও দেখা যায় শুধুমাত্র বরিশাল জেলাতেই ২,৫০০ প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। সব মিলিয়ে পূর্ব বঙ্গে মৃতের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজার! সব খোয়ানো নারী-শিশুদের স্বজন হারাবার হাহাকারে আমার হৃদয় দ্রবীভূত হয়ে গিয়েছিল। আমি নিজের কাছেই জানতে চাইলাম “ইসলামের নামে পাকিস্তানে কি ঘটতে চলেছে”।
দিল্লী চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিকতার অভাব
২৩। মার্চের শেষভাগে বিশাল সংখ্যায় হিন্দুরা বাংলা ছাড়তে শুরু করে। মনে হচ্ছিল কিছুদিনের মধ্যেই সকল হিন্দু ভারতে চলে যাবে। ভারতে রণধ্বনি বেজে উঠলো। পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়ল। জাতীয় দুর্যোগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে দেখা দিল। ৮ এপ্রিলের দিল্লী চুক্তি অবশ্য এই অনুমিত দুর্যোগকে থামিয়ে দিতে পারল। ভয়ার্ত হিন্দুদের মনোবল পুনরুদ্ধারের আশায় আমি সারা পূর্ব বাংলা চষে বেড়ালাম। আমি ঢাকা, বরিশাল, ফরিদপুর, খুলনা ও যশোরের অনেক স্থান পরিদর্শন করলাম। আমি বহু বড় বড় জনসমাবেশে হিন্দুদের নিকট আহ্বান জানাই তারা যেন তাদের সাহস ধরে রাখে এবং নিজেদের পূর্বপুরুষের ভিটা-মাটি ছেড়ে না যায়। আমি আশা করেছিলাম যে পূর্ব বাংলার সরকার এবং মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ দিল্লী চুক্তির শর্তসমূহ যথাযথভাবে পালন করবে। কিন্তু যতই সময় গড়াতে লাগল আমি উপলব্ধি করলাম এই দুই পক্ষের কেউই দিল্লী চুক্তির শর্তাদি পালনের ব্যাপারে প্রকৃতরূপে উৎসাহী নয়। দিল্লী চুক্তির শর্ত মোতাবেক একটি সিস্টেম দাঁড় করাতে পূর্ব বাংলার সরকার যে শুধুমাত্র অক্ষম ছিল তাই নয়, সেই বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপও তারা নিতে চায়নি। দিল্লি চুক্তির পরপর বেশ কিছু হিন্দু তাদের নিজ বাসভূমে ফিরলেও ইতিমধ্যে মুসলিমদের দখলে চলে যাওয়া তাদের জায়গা-জমি ও ঘরবাড়ি আর ফিরে পায়নি।
মাওলানা আকরাম খানের প্রেরণায়
২৪। ‘মোহাম্মাদী’ নামক একটি মাসিক পত্রিকার ‘বৈশাখ’ সংখ্যায় ছাপা হওয়া প্রাদেশিক মুসলিম লিগের সভাপতি মাওলানা আকরাম খানের সম্পাদকীয় পড়ে লিগের নেতৃবৃন্দের মনোভাব সম্বন্ধে আমার অনুমান যে অভ্রান্ত তা আমি বুঝতে পারি। ঢাকা রেডিও স্টেশন থেকে পাকিস্তানের সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী ড. এ. এম. মালিকের প্রচারিত প্রথম রেডিও বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তিনি এই সম্পাদকীয় লিখেন। ড. মালিক বলেন, “এমনকি নবী হযরত মুহম্মদ(সাঃ)ও আরবের ইহুদীদের নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন”। মাওলানা আকরাম খান এর প্রেক্ষিতে বলেন, “ড. মালিক তাঁর বক্তব্যে আরবের ইহুদীদের প্রসঙ্গ না টানলেই ভাল করতেন। এটা সত্য যে নবী হযরত মুহম্মদ(সাঃ) আরবের ইহুদীদের নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন; কিন্তু সেটা ছিল ইতিহাসের প্রথম অংশ মাত্র। শেষদিকে তাঁর সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ছিল এরকম – আরব থেকে সকল ইহুদীদের বিতাড়িত কর”। মুসলিম সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক জীবনে অতি উচ্চ পদে আসীন একজন ব্যক্তির এহেন মন্তব্যের পরেও আমি আশা করে ছিলাম যে নুরুল আমিন মন্ত্রীসভা এতটা আন্তরিকতাশূন্য হবেনা। কিন্তু দিল্লী চুক্তির শর্ত মেনে নিতে যখন নুরুল আমিন ড. এন. বারারীকে মন্ত্রী মনোনীত করলেন তখন আমার সমস্ত আশা চূর্ণ হয়ে গেল। শর্তে ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে তাদের একজন করে প্রতিনিধি পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিমবাংলার মন্ত্রীসভায় নিয়োগ পাবে।
নুরুল আমিন সরকারের আন্তরিকতাশূন্য কার্যকলাপ
২৫। আমার এক সাধারণ বিবৃতিতে আমি ড. এন. বারারীকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেবার ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে বলি যে এর ফলে কোনও বিশ্বাস তো ফেরত আসবেই না বরং নুরুল আমিন সরকারের আন্তরিকতা বিষয়ে যদি সংখ্যালঘুদের মনে কিছু আশার মরীচিকা তখনও জেগে থাকে তবে তাও পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। আমার নিজস্ব মত হল নুরুল আমিনের সরকার যে শুধু আন্তরিকতাহীন কাজ করেছে তাই নয়, তাদের ইচ্ছা ছিল দিল্লি চুক্তির প্রধান প্রধান লক্ষ্যসমূহ অর্জনে বাধা প্রদান করা। আমি আবারো বলতে চাই যে ড. এন. বারারী নিজেকে ছাড়া আর কারও প্রতিনিধিত্ব করেন না। তিনি কংগ্রেসের টিকিটে সংগঠনটির টাকা এবং সাংগঠনিক শক্তির সুবাদে বাংলার আইনসভায় ফিরে আসতে সক্ষম হন। তিনি নমঃশূদ্রদের ফেডারেশনটির প্রার্থীদের বিরোধিতা করেছিলেন। নির্বাচিত হবার কিছুদিন পর তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ফেডারেশনে যোগ দেন। মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হবার কালে তিনি ফেডারেশনেরও সদস্য ছিলেন না। বাঙালি হিন্দুরা আমার সঙ্গে একমত হবেন যে পূর্ববর্তী কার্যকলাপ, চরিত্র এবং বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে দিল্লী চুক্তি অনুসারে মন্ত্রী নিযুক্ত হবার পক্ষে বারারী বিবেচনার উপযুক্ত নন।
(ক্রমশ........)
জিন্নার হিন্দু মন্ত্রীর পাঁচালি -পর্ব ৪
জিন্নার হিন্দু মন্ত্রীর পাঁচালি -পর্ব ৩
জিন্নার হিন্দু মন্ত্রীর পাঁচালি - পর্ব ২
জিন্নার হিন্দু মন্ত্রীর পাঁচালি - পর্ব ১
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook এবং Twitter পেজ।
+ There are no comments
Add yours