মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: পট পরিবর্তন। তখন সময়টা ছিল ১৯৩০। ভারত তখন ব্রিটিশ শাসনের অধীনে পরাধীন রাষ্ট্র। মহাত্মা গান্ধীর স্বদেশী আন্দোলনে হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল এই চরকা। পরে, যা স্বাধীনতা আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। গান্ধীর চরকা রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল ব্রিটিশদের। অচিরেই, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়েছিল এই দেশ।
এখন ২০২২। ভারত স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষপূর্তি পালন করছে মহা ধুমধামের সঙ্গে। আর ভারতে এসেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। এদেশে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর আগমন নতুন কিছু নয়। তবে, জনসনের এই সফর, অনেক দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য বটে। কারণ, এই প্রথম কোনও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গান্ধীর সবরমতী আশ্রমে পা রাখলেন। তার চেয়েও বড় কথা, যে চরকা একদিন ব্রিটিশদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল, যে চরকা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত গড়ে দিয়েছিল, এখন সেই সবরমতী আশ্রমে সেই চরকার সামনে পা মুড়ে বসে সুতো কাটলেন এক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। ছবিও তুললেন।
স্বাধীনতা উত্তর ভারতের এই ছবি, যেন ১৩৩ কোটি দেশবাসীর কাছে একটা গর্বের মুহূর্ত। যে ছোটখাটো মানুষটির অহিংস আন্দোলন কাঁপিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে, আজ তাঁরই ঘরে পা দিলেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী। আজ থাকলে হয়তো খুব খুশি হতেন মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধী।
বৃহস্পতিবার, আহমেদাবাদ হয়ে দু’দিনের ভারত সফর শুরু করার পরে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের প্রথম গন্তব্যই ছিল মহাত্মা গান্ধীর সবরমতী আশ্রম। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র পটেল এবং আশ্রমের ট্রাস্টি কার্তিকেয় সারাভাই সেখানে তাঁকে স্বাগত জানান। প্রায় আধ ঘণ্টা আশ্রমে ছিলেন জনসন। গান্ধী যেখানে থাকতেন, সেই ‘হৃদয় কুঞ্জ’, গান্ধীর বিদেশিনি শিষ্যা মীরাবেন (মেডেলিন স্লেড)-এর বাসস্থান ‘মীরা কুটির’ ঘুরে দেখেন তিনি। গান্ধীর মূর্তিতে মালা দেন। চলে যাওয়ার ঠিক আগে বরিস বসে পড়েন চরকায়। পাশে বসে এক মহিলা তাঁকে শিখিয়ে দেন, কী ভাবে চালাতে হয় চরকা।
১৯১৭ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত গুজরাতের এই সবরমতী আশ্রমই ছিল মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধীর ঠিকানা। এখান থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেছিলেন গান্ধী। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল গান্ধীকে 'হাফ ন্যাকেড ফকির' বলে সম্মোধন করেছিলেন। আজ তাঁর উত্তরসূরীর কথায় গাঁধী ছিলেন 'এক অসামান্য মানুষ'। এদিন সবরমতী আশ্রম ছেড়ে যাওয়ার সময় সেখানকার ভিজিটার্স বুকে জনসন লেখেন, ‘‘এই অসামান্য মানুষটি কীভাবে দুনিয়ায় বদল আনতে সত্য ও অহিংসার সহজ নীতিকে কাজে লাগিয়েছিলেন, এখানে এসে তা বুঝতে পেরে সমৃদ্ধ হলাম।’’
এদিন তাঁর হাতে সবরমতী আশ্রম প্রিজ়ার্ভেশন অ্যান্ড মেমোরিয়াল ট্রাস্টের তরফে দু’টি বই তুলে দেন বিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাইয়ের পুত্র কার্তিকেয়। আর দেওয়া হয় একটি চরকার প্রতিরূপ। আশ্রমের মুখপাত্র বিরাট কোঠারি বলেন, ‘‘ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া দু’টি বইয়ের একটি হল, ‘গাইড টু লন্ডন’। এটি গান্ধীর লেখা প্রথম বই, যা কখনও প্রকাশিত হয়নি। লন্ডনে কী ভাবে থাকতে হয়, তা নিয়েই গান্ধী এখানে নিজের মতামত লিখেছিলেন। তাঁর রচনাবলি থেকে লেখাটি সংগ্রহ করে সেটিকে আলাদা বইয়ের চেহারা দিয়েছি আমরা।’’ অন্য বইটি মীরাবেনের আত্মজীবনী— ‘দ্য স্পিরিট’স পিলগ্রিমেজ’।
ভারতে পা দিয়েই জনসন টুইট করেছিলেন, ‘‘বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতে এসে দারুণ লাগছে। একসঙ্গে আমাদের দুই দেশ বিরাট সম্ভাবনা ছুঁতে পারে। আমাদের অংশীদারিত্বেই আসবে চাকরি, বৃদ্ধি, সুযোগ। ভবিষ্যতে এই সহযোগিতা আরও মজবুত করতে চাই।’’ বিমানবন্দরে জনসনকে স্বাগত জানান গুজরাতের রাজ্যপাল আচার্য দেবব্রত, মুখ্যমন্ত্রী পটেল-সহ অন্য কয়েক জন মন্ত্রী ও রাজ্য সরকারের শীর্ষ কর্তারা। আহমেদাবাদ বিমানবন্দর থেকে শুরু করে শহরে জনসনের ঠিকানা পাঁচতারা হোটেলটি পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার রাস্তার ধারে গোটা চল্লিশেক মঞ্চ বাঁধা হয়েছিল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কনভয় যখন যাচ্ছে, তখন সেই মঞ্চগুলিতে আঞ্চলিক নাচগান করছিলেন শিল্পীরা। বিমানবন্দর থেকে দফনালা, রিভারফ্রন্ট হয়ে আশ্রম রোডের হোটেলে পৌঁছন জনসন। একটু পরেই যান গান্ধী আশ্রমে। সেখান থেকে আহমেদাবাদ-লাগোয়া শান্তিগ্রামে আদানি গোষ্ঠীর সদর দফতরে এসে বৈঠকে বসেন শিল্পপতি গৌতম আদানির সঙ্গে।
গুজরাতি শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠক বা সবরমতী আশ্রমে তাঁর সফর ব্রিটেনে বসবাসকারী গুজরাতিদের মন গলাতে সাহায্য করবে, বলে মনে করে কুটনৈতিক মহল। ব্রিটেনে বসবাসকারী ভারতীয়দের ৫০ শতাংশ গুজরাতি বংশোদ্ভূত। জনসনকে ক্ষমতায় আনার জন্য পরোক্ষভাবে ব্রিটেনে বসবাসকারী ভারতীয়েরা সাহায্য করেছিল বলে মনে করা হয়।
+ There are no comments
Add yours